বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৪০ অপরাহ্ন
রফিকুল ইসলাম॥ মেঘলা আকাশ। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। ঝিরি ঝিরি পুবালি বাতাস, তার সঙ্গে কাঁপন ধরানো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি! বৃষ্টির সঙ্গে পুবালি হাওয়া বইলেই যেন টের পায় ইলিশের ঝাঁক। সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে ইলিশ ঢুকতে থাকে নদীতে। ইলিশ ধরার এমন আদর্শ আবহাওয়া অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের পাতায় রয়েছে।
জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু জ্যৈষ্ঠেও এমন আবহাওয়া মেলা দুষ্কর। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহর থেকে বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ হচ্ছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির অভাবে তাই ইলিশেও আপাতত লকডাউন!
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত বর্ষা জাঁকিয়ে বসার পরেই সাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক শাখা নদীতে ঢুকতে শুরু করে। কারণ, বর্ষায় মোহনার কাছে পানির লবণাক্ততা ও মিষ্টতার আনুপাতিক হার বদলে যায়। সেই জন্যই জ্যৈষ্ঠেই নদীর ভেতরে ইলিশের ঝাঁক ঢুকতে শুরু করে। কিন্তু ইলিশের দেখা নেই। আষাঢ়ের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে রুপালি শস্যের (ইলিশ) দেখা মিলবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৃষ্টির পরিমাণ কম হলে অনেক সময় ইলিশের আগমন পিছিয়ে যায়। তাছাড়া লকডাউনের দরুন নদী দূষণ কমেছে। তার জেরে জেলেদের ইলিশ-ভাগ্য প্রসন্ন হতে পারে। জেলেদের অনেকেই ভেবেছিলেন, লকডাউনে দূষণহীন নদী উপচে পড়বে রুপালি শস্যে। জ্যৈষ্ঠের এ সময়ে ইলিশে ইলিশে সয়লাব হয়ে যাবে কলাপাড়া থেকে পাথরঘাটা। কিন্তু কোথায় কি?
কেন এমন অকাল ইলিশের?
কুয়াকাটার এলাকার মাছের পাইকার জাকির হোসেনের কথায়, এবার যা হাল নদী তো দূরের কথা সাগরে ইলিশ আছে বলেই মনে হচ্ছে না! অথচ আমাদের হিসাব ছিল অন্য রকম। টানা তিন চার মাস মাছ ধরা হয়নি লকডাউনে। হিসাব মতো ইলিশ কেজি সাইজে বেড়ে যাওয়ার কথা। আমরা সেই অঙ্ক কষে মাছের অর্ডার নিয়েছি। কিন্তু কোথায় মাছ! যাও একটা দুটো জেলেদের জালে আটকাচ্ছে, তারও ওজন গড়ে সাড়ে চার শ গ্রাম হবে। দাম ৭০০ টাকার আশপাশে। ওই দামে কে কিনবে ইলিশ?
পাথরঘাটার রুহিতা গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী ইউসুফ হোসেন বলেন, গভীর সমুদ্রে প্রচণ্ড গরম। বৃষ্টির দেখা নেই। পানি খুব কম। তাছাড়া নদীমুখী পানির প্রবাহ নেই। তাই সাগরে ইলিশের দেখা নেই। শুধু বিশখালী, পায়রা থেকেই হাতে গোনা কিছু ইলিশ আসছে। মেঘনার ইলিশের কোনো খবর নেই। তবে সব দিন সমান নয়। গড়ে পাঁচ শ’র ওপরে মাছ নেই। দাম ৬০০-৭৫০ টাকা।
মেঘনা তীরের ইলিশ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মিলন বলেন, এবার মেঘনায় এখনো ইলিশ ওঠেনি। যা কিছু ইলিশ আসছে সবই আশপাশের নদী থেকে। তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে বাজারে সেভাবে ইলিশের দেখা মিলছে না। তাঁর মতে, আষাঢ় থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ইলিশের দেখা মিলতে পারে। তার পর যদি কিছু পরিবর্তন হয়।
তারা যা বলছেন
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশ মাছের মৌসুম পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই জ্যৈষ্ঠও ইলিশ ধরা পড়ছে না। তার মতে, বিষয়টি চিন্তার হলেও এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। জেলেদের জালে যে একদমই মাছ ধরা পড়ছে না তা কিন্তু নয়। ইলিশ ধরা পড়ছে তবে পরিমাণে কম। আগামীতে আরো বেশি পড়বে।
তিনি আরো বলেন, সামুদ্রিক মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ করতে বুধবার (১৯ মে) মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
ইলিশের আকার-আকৃতি, ওজন, প্রজনন ও দাম নিয়ে নিয়মিত জরিপ করে মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকো ফিশ প্রকল্প। ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল ওহাব। তিনি মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, সাগরে পানির প্রবাহ কম, তাই ইলিশ নদীতে আসছে না।
অধ্যাপক আবদুল ওহাব আরো বলেন, জেলেদেরকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। এবারও বড় সাইজের ইলিশ প্রচুর পরিমাণে জেলেদের জালে ধরা পড়বে। কারণ ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা সরকার কঠোরভাবে পালন করেছে। জেলেরা এই সময়ে নদীতে নামেননি, তাই ঝাটকা বড় সাইজের ইলিশ পরিণত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরির্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। এ বছর প্রচুর ইলিশ উৎপাদন হতে পারে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। জুনের প্রথম ভাগেই ইলিশ ধরা পড়তে পারে।
Leave a Reply